সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮

******* পিতৃ ঋণ *******



"বাবা তুমি তো বলেছিলে পিতৃ ঋণ কোনদিন শোধ হয় না। তুমি ছাব্বিশ বছরে আমার পেছনে যত টাকা খরচ করেছো তুমি কি জানো আমি আগামী তিন বছরে সে টাকা তোমায় ফিরিয়ে দিতে পারবো"।
বাবা : ( কিছুটা মুচকি হেসে) "একটা গল্প শুনবি?"
ছেলেটা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নিচু স্বরে বললো-
"বলো বাবা শুনবো......"

তোর বয়স যখন চার আমার মাসিক আয় তখন দু হাজার টাকা। ওই টাকায় সংসার চালানোর কষ্ট বাড়ির কাউকে কখোনো বুঝতে দেইনি। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে সব সময় চেষ্টা করেছি তোর 'মা কে 'সুখী করতে। তোকে যেবার স্কুলে ভর্তি করলাম সেবার ই প্রথম আমরা দুজন- আমি-আর তোর মা পরিকল্পনা করেছি আমরা তোর পড়ার খরচের বিনিময়ে কি কি ত্যাগ করবো।

সে বছর তোর মাকে কিছুই দিতে পারিনি আমি। তুই যখন কলেজে উঠলি আমাদের অবস্থা তখন মোটা মুটি ভাল। কিন্তু খুব কষ্ট হয়ে
গেছিল যখন তোর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ঔষধ কেনার জন্য রোজ রোজ ওভারটাইম করে বাসে করে পায়ে হেটে ঘামে ভিজে বাড়ি ফিরতে খুব দুর্বিষহ লাগতো। কিন্তু কখোনো কাউকে বুঝতে দিইনি এমনকি তোর মা কেও না।

একদিন শো রুম থেকে একটা বাইক দেখে আসলাম। সে রাতে আমি স্বপ্নেও দেখেছিলাম আমি বাইকে চড়ে কাজে যাচ্ছি। কিন্তু পরের দিন তুই বায়না ধরলি ল্যাপটপ এর জন্য। তোর কষ্টে আমার কষ্ট হয় বাবা। আমি তোকে ল্যাপটপ টা কিনে দিয়েছিলাম। আমার তখনকার এক টাকা তোর এখন এক পয়সা! কিন্তু মনে করে দেখ এই এক টাকা দিয়ে তুই বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করেছিস। ব্রান্ড নিউ মোবাইলে হেড ফোন কানে লাগিয়ে সারা রাত গান শুনেছিস। পিকনিক করেছিস, ট্যুর করেছিস, কন্সার্ট দেখেছিস। তোর প্রতিটা দিন ছিল স্বপ্নের মতো।

আর তোর একশ টাকা নিয়ে আমি এখন সুগার মাপাই । জানিস আমার মাছ খাওয়া নিষেধ, মাংস খাওয়া নিষেধ, কি করে এত টাকা খরচ করি বল! তোর টাকা নিয়ে তাই আমি কল্পনার হাট বসাই। সে হাটে আমি বাইক চালিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াই। বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যাই। তোর মায়ের হাত ধরে তাঁত মেলায় ঘুরে বেড়াই।
বাবারা নাকি "খাড়ুশ টাইপের" হয় । আমিও আমার বাবাকে তাই ভাবতাম । পুরুষ থেকে পিতা হতে আমার কোনো কষ্ট হয়নি, সব কষ্ট তোর মা সহ্য করেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর পিতা থেকে দ্বায়িত্বশীল পিতা হবার কষ্ট একজন পিতাই বোঝে। যুগে যুগে সর্বস্থানে মাতৃবন্দনা
হলেও পিতৃবন্দনা কোথাও দেখেছিস ?

পিতৃবন্দনা আমি আশাও করি না। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা কোনো পিতা হয়তো প্রকাশ করতে পারে না,তবে কোনো পিতা কখনোই সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনে বিচ্যুত হয় না। আমি তোর পেছনে আমার যে কষ্টার্জিত অর্থ ব্যায় করেছি তা হয়তো তুই তিন বছরে শোধ দিতে পারবি...

কিন্তু যৌবনে দেখা আমার স্বপ্ন গুলো ?
যে স্বপ্নের কাঠামোতে দাঁড়িয়ে তুই আজ তোর ঋণশোধের কথা বলছিস.
সেই স্বপ্ন গুলো কি আর কোনোদিন বাস্তব রুপ পাবে ?
আর যদি বলিস বাবা আমি তোমার টাকা না তোমার ভালবাসা তোমায় ফিরিয়ে দেব, তাহলে বলবো বাবাদের ভালবাসা কখনো ফিরিয়ে দেয়া যায় না।

 তোকে একটা প্রশ্ন করি, ধর তুই আমি আর তোর খোকা তিন জন এক নৌকায় বসে আছি। হটাৎ নৌকা টা ডুবতে শুরু করলো....
যে কোন একজনকে বাঁচাতে পারবি তুই।
কাকে বাঁচাবি ?
( ছেলেটা হাজার চেষ্টা করেও এক চুল ঠোঁট নড়াতে পারছেনা! )
উত্তর দিতে হবে না। ছেলেরা বাবা হয়, বাবা কখনো ছেলে হতে পারে না।

পৃথিবীতে সব চেয়ে ভারী জিনিস কি জানিস?
পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ!u
আমি শুধু  একটা জিনিস চাই।
আমার শেষ যাত্রায় যেন আমি আমার ছেলের কাঁধে চড়ে যাই। তাহলেই তুই একটা ঋণ শোধ করতে পারবি -
তোকে কোলে নেবার ঋণ।

collected by Runu

রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মধু পূর্নিমা ও আটাশ বুদ্ধের পূজা এবং সংঘদানের একাংশ

প্রতি বছরের ন্যায় এই বছর ও মধু পূর্ণিমার পরের দিন মায়ানী গৌতম বিহার কমপ্লেক্সে প্রয়াত ভদন্ত তিলক চাঁন মহাস্থবির,ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাস্থবির, ভদন্ত অরিন্দম মহাস্থবির, ভদন্ত তিলোকলংকার ভিক্ষু ও প্রয়াত ভূমি দাতাগনের পূণ্যস্মৃতি স্মরণে এবং উপাসক উপাসিকার ধর্মময় নিরোগ দীর্ঘায়ু কামনায় ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্রপাঠ,আটাশ বুদ্ধের পূজা ও অষ্টপরিষ্কারসহ সংঘদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ভিক্ষু সংঘ ও দায়ক দায়িকার একাংশ।










সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৫




বৌদ্ধধর্ম কেন মহাজাগতিক ?
============================= 

মহাজাগতিক মূলনীতি প্রকৃতপক্ষে কোন নীতি বা তত্ত্ব নয়, বরং এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ। এটি বিপুল পরিমাণ মহাজাগতিক তত্ত্বের কার্যকারিতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। মহাবিশ্বের বৃহৎ-পরিসর গঠন থেকে এই স্বতঃসিদ্ধটি উৎপত্তি লাভ করে। এই নীতির বিবৃতিটি হচ্ছে:
“ বৃহৎ স্প্যাশিয়াল স্কেলে (spatial scale) মহাবিশ্ব সমসত্ব (homogeneous) এবং সমতাপীয় (isotropic) ।
আসুন জেনে নিই এ নিয়ে প্রচলিত ধর্ম ও বিজ্ঞান কি বলে .........
ধর্ম , বিজ্ঞান এবং মহাজাগতিকতাঃ
মানুষ আজ পর্যন্ত চিন্তায় ও কর্মে যা কিছু অর্জন করেছে সবই হয় কোন গভীর ভাবে অনুভূত প্রয়োজন মেটাতে অথবা কোন যন্ত্রণা এবং কষ্ট লাঘবের জন্য। আধ্যাত্মিক ভাবনা-চেতনা, সেই সংক্রান্ত আন্দোলনসমূহ এবং তাদের বিবর্তন ও অগ্রগতি ভালভাবে বোঝবার জন্য এই কথাটা সব সময় মাথায় রাখতে হবে। অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা, তা আমাদের সামনে যে মহৎ আবরণেই উপস্থিত হোক না কেন মানুষের সকল চেষ্টা ও সৃষ্টির পিছনে সেই হচ্ছে সঞ্চালনী শক্তি। তাহলে ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাসের পিছনে মানুষের কোন প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি কাজ করেছে? এসব শব্দগুলির বৃহত্তর অর্থকে মনে রেখে আমরা এখন তা ভেবে দেখতে পারি। একটু বিচার বিবেচনা করলেই দেখা যাবে ধর্মীয়চিন্তা ও অভিজ্ঞতার ওপরে মানুষের বিচিত্র সব আবেগের প্রভাব আছে।

ধর্মের এই বিভিন্ন প্রকারভেদের মধ্যে সাধারণভাবে ঈশ্বরের ধারণা মানবকেন্দ্রিক বা মানবিক। কেবলমাত্র অসাধারণ মানসিকতাসম্পূর্ণ মানুষ অথবা জনগোষ্ঠিকেই এই প্রকার ধারণার ঊর্ধে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু এই সমস্ত ছাড়াও তৃতীয় এক প্রকার ধর্মীয় অনুভূতি সব ধর্মেই সম্ভব হতে পারে-যদিও বিশুদ্ধ চেহারায় তার দেখা পাওয়া হয়ত বিরল ঘটনা। আমি এটাকে বলব 'মহাজাগতিক ধর্মীয় চেতনা।' যিনি এটাকে মোটেই অনুভব করেননি তাঁর কাছে এটা ব্যাখ্যা করা মুস্কিল, কারণ মানবিক বা মানবকেন্দ্রিক ঈশ্বরের অনুভূতির সঙ্গে এই চেতনার কোন সংযোগ নেই।

যার মধ্যে এই চেতনা আসে তিনি বিশ্বব্রক্ষ্ণাণ্ডের সর্বত্র এক ভাবগম্ভীর শৃঙ্খলা বোধ যা প্রকৃতি ও চিন্তাজগৎ সবখানেই পরিব্যাপ্ত তা অনুভব করেন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাশার তুচ্ছতাও হৃদয়ঙ্গম করেন। তখন শুধুই নিজেকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা, যা আমাদের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব, তাকে মনে হয় কারাগারে আবদ্ধ এক বন্দীর মতন। বিশ্বের সর্বময় পরিব্যাপ্তিকে একই সঙ্গে অনুভব করতে উদ্বুদ্ধ হয় মন, এই মহাজাগতিক ধর্মীয় চেতনার প্রাথমিক প্রকাশ আমরা অপেক্ষাকৃত প্রাচীন রচনাতেও দেখতে পাই, যেমন ডেভিড ও অন্য কয়েকজন ধর্মপ্রচারকের স্তোত্রে। শোপেনহাওয়ারের লেখা থেকে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, সেখানেও এই অনুভুতির জোরালো প্রকাশ রয়েছে।
সকল যুগের যেসব প্রতিভাশালী ব্যক্তি ধর্ম নিয়ে চর্চা করেছেন তাঁরা প্রতেকেই এই ধরনের চেতনা অনুভব করেছেন যা সমস্ত গোঁড়ামির ঊর্ধে। যেখানে ঈশ্বরকে মানুষের আদলে চিন্তা করা হয়নি, তাই চার্চের মত উপদেশদানকারী কোন কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সেখানে স্থান নেই।

তাই সকল যুগের প্রচলিত ধর্ম মতের বিরোধী কিছু মানুষের মধ্যেই আমরা এই চেতনা দেখতে পেয়েছি এবং তাঁদের কাউকে নাস্তিক আবার কাউকে জ্ঞানী পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই আলোকে বিচার করলে ডেমোক্রিটাস, আসিসির অধিবাসী ফ্রান্সিস অথবা স্পিনোজা একই ধরনের মানুষ ছিলেন। এই মহাজাগতিক ধর্মীয় অনুভুতিতে কোন নির্দিষ্ট ঈশ্বর বা তত্ত্বকথার ধারনা নেই, তাহলে কেমন করে তা একের থেকে অন্যের কাছে পৌঁছুবে? আমার মতে এই চেতনাকে জাগিয়ে রাখা বিজ্ঞান ও ধর্মের অন্যতম প্রধান অর্জন হতে পারে।

এভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞান ও ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ককে অভ্যস্ত ধারনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রায় দেখতে পারা যায়। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, বিজ্ঞান ও ধর্ম যে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর অধিবাসী দুই বিরোধী বিষয়বস্তু এটাই মনে হওয়াই স্বাভাবিক। বিশ্বব্রম্ভান্ডের ঘটনাস্রোতে কার্যকারন সূত্রের প্রয়োগে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী কোন মানুষই মাঝখানে কোন অস্তিত্ব সেই ঘটনা ক্রমকে ইচ্ছামত পরিবর্তিত করতে পারে এটা মেনে নিতে পারে না।

এই ধরনের যুক্তিবাদী মানুষের কাছে ভয়ের ওপর ভিত্তি করে ওঠা ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই, সামাজিক ও নৈতিক ধর্মও তার কাছে একই মূল্য রাখে। পুরস্কৃত করেন অথবা শাস্তি দেন এমন কোন ঈশ্বর তার ধারনাতে আসবেনা। কার্যকারণ সম্পর্কের যুক্তিতে মানুষ যা কিছু করে তার সবই তার নিজস্ব পূর্বনির্দিষ্ট প্রয়োজন অথবা বাইরের কোন অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন মেটাতেই। সুতরাং নিষ্প্রান বস্তুসমুহ তাদের গতি প্রকৃতির জন্য যেমন নিজেরা দায়ী নয়, ঈশ্বরের বিচারে মানুষের কৃতকর্মের জন্য দায়িত্বও তার থেকে বেশী কিছু হওয়া উচিৎ নয়।

এই সব যুক্তি উপস্থিত করে বিজ্ঞান নীতিবোধের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে এই রকম একটা অভিযোগ করা হয়েছে - কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অভিযোগ ন্যায়সঙ্গত নয়। মানুষের নৈতিক ব্যবহার নির্ধারিত হওয়া উচিৎ তার সহানুভুতি, শিক্ষা, সামাজিক বন্ধন ও প্রয়োজন - এ সবের উপর ভিত্তি করে। এর জন্য ধর্মীয় শাস্তির ভয় অথবা পুরস্কারের আশা দিয়ে নিয়ন্ত্রন করতে হয় তবে বুঝতে হবে মানুষের পরিস্থিতি দুঃখজনক।

তাই চার্চ কেন সর্বদাই বিজ্ঞানের সঙ্গে লড়াই করেছে এবং তার অনুগতদের শাস্তি দিয়েছে তা অনুধাবন করা সহজ। অপর পক্ষে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই মহাজাগতিক ধর্মিয় অনুভুতি বিজ্ঞান গবেষনার জন্য সর্বাধিক প্রেরনাদায়ী মহত্তম চালিকা শক্তি। বিজ্ঞানের কোন নতুন তত্ত্বগত ধারনা নিয়ে মৌলিক দিগনির্দেশক গবেষনা করতে গেলে গভীর নিষ্ঠা, অসাধারন চেষ্টা ও পরিশ্রমের প্রয়োজন। যারা এই নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টা সম্বন্ধে প্রকৃত ধারনা রাখেন, শুধু তাঁরাই বুঝতে পারবেন যে কি পরিমান আন্তরিক আবেগ থাকলে তবে দৈনন্দিন আপাত দৃশ্য জগৎ থেকে দুরে শুধু গভীর কোন তাত্ত্বিক ধারনা নিয়ে এভাবে সুদীর্ঘ সময় ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা যায়।

কেপলার আর নিউটনের কথা ভেবে দেখুন। মহাবিশ্বে ধাবমান গ্রহ নক্ষত্রের গতি প্রকৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করবার সুগভীর আকাঙ্ক্ষা থাকলে তবেই এই রকম সাধনা করা সম্ভব। বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে যাঁদের ধারনা শুধু তার ব্যবহারিক ফল ও প্রয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ তাঁরা গবেষণা কাজে নিয়োজিত এসব নিবেদিত প্রাণ মানুষের মন-মানসিকতা সম্বন্ধে সহজেই ভুল ধারনা করে থাকেন। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে চারদিকে সন্দেহ ও বিরুদ্ধতার মধ্যে অটল বিশ্বাসের একই মানসিকতা নিয়ে তাঁরা সবাই কাজ করে গেছেন। যে সমস্ত মানুষ তাঁদের সারা জীবন এই রকমই কোন কাজে নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়োজিত থেকেছেন, শুধু তাঁরাই এই সব গবেষক ও কর্মীদের সংখ্য ব্যর্থতা সত্ত্বেও মূল লক্ষ্যে অবিচল থাকার প্রেরনা ও তার শক্তি সম্বন্ধে কোন পরিষ্কার উপলব্ধি পেতে পারেন। শুধুমাত্র এক মহাজাগতিক ধর্মীয় অনুভুতিই তাদের এই শক্তি দিতে পারে। আমাদের সমসাময়িক কোন মনীষী ঠিকই বলেছেন যে আমাদের এই বস্তুতান্ত্রিক যুগে একমাত্র নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানকর্মীরাই হচ্ছেন সবচেয়ে ধার্মিক মানুষ।

বৌদ্ধ ধর্ম কেন মহাজাগতিকঃ
আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে প্রচলিত ধর্মগুলোর বিরোধের প্রধান কারন হলো-----
১. সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর বিশ্বাস
২.ধর্মীয় সৃষ্টি রহস্য
৩. ঐশ্বরিক বাণী অর্থাৎ অলৌকিকতা
৪. আত্মার অবিনশ্বরতা
৫. অনিরীক্ষনীয় ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস

বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এগুলির প্রমান সার্থকতার মাপকাঠিতে টিকে থাকেনা বরং প্রানী বিবর্তনবাদ থেকে বিজ্ঞানের বহু মৌলিক আবিষ্কারে উপরোক্ত ধারনার ভ্রান্ততা পরিলক্ষিত হয়। এমতাবস্থায় বিজ্ঞানের সাথে বৌদ্ধধর্মের সম্পর্ক কি তা জানা যথেষ্ঠ কৌতুহলজনক । কারন বিশ্বের খ্যাতনামা ধর্ম যাজক ও বিজ্ঞানীরা অভিমত দিয়েছিলেন যে , আগামীর বিশ্বে মহাজাগতিক ধর্ম বলতে থাকবে বৌদ্ধধর্ম । কিন্তু আমার দৃষ্টিতে বৌদ্ধধর্ম সৃষ্টির পর থেকেই মহাজাগতিক ( Cosmical) । কারন বিজ্ঞান যেভাবে মহাজাগতিকতার ধারনা দিয়েছেন তার প্রত্যেকটি তত্ত্ব চুলছেড়া বিশ্লেষিত হয়েছে বুদ্ধতত্ত্বের প্রতীত্য সমূৎপাদ তত্ত্বে ।

আসুন জেনে নিই কোন ভিত্তিতে বিজ্ঞান বৌদ্ধধর্মকে মহাজাগতিক ধর্ম (Cosmical Religion) হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ
জড় বিশ্বের অবস্থা সম্বন্ধে আইনস্টাইন সাপেক্ষবাদ(Theory Of Relatively) বর্তমান বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও গৌতম বুদ্ধ দুইহাজার পাঁচশত সাতান্ন বছর পুর্বে এ সম্পর্কে প্রতীত্য সমূৎপাদ তত্ত্ব আবিষ্কার করে জ্ঞানী জগতকে অবাক করে দিয়েছেন। 

আধুনিক বিজ্ঞানিদের মতো বুদ্ধ বলেছেন , এ জগতে কোন প্রানী, বস্তু বা ঘটনা আত্মনির্ভর নয় এবং বিনা কারনে বা আকস্মিকভাবে কিছু ঘটে না । প্রতিটি বস্তু বা ঘটনার কারন আছে। বিজ্ঞান অবশ্য এই স্বীকার্য তত্ত্বের নাম দিয়েছেন কার্যকারন সম্বন্ধ (Casual Relation) । আর বুদ্ধ একে বলেছেন প্রতীত্য সমূৎপাদ তত্ত্ব । কার্যকারন সম্বন্ধের উপরেই বুদ্ধের এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত । 

বৌদ্ধধর্ম মতে এই কার্যকারন নিয়ম জগতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে, এটা নিয়ন্ত্রন করার জন্য কোন ঈশ্বর( God) বা বাহ্যিকশক্তির ( External Power) প্রয়োজন হয়না । 

এই মতবাদের মাধ্যমে বুদ্ধ জগত তথা প্রাণী সৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যা করেছেন । তাই এই কার্যকারন মতবাদই বুদ্ধধর্মের ভিত্তি ।
বৌদ্ধধর্মের কর্মতত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মতবাদের সাথে সম্পুর্ন সামঞ্জস্যপুর্ণঃ 
বৌদ্ধধর্মের কর্মতত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত । কর্মবাদ অনুযায়ী যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল পাবে । বিজ্ঞানের ভাষায় যা বলা হয়েছে প্রত্যেক কর্ম/ক্রিয়ার (Action) বিপরীত প্রতিক্রিয়া (Reaction) আছে। পৃথিবীর কোথাও এই নিয়মের ব্যাতিক্রম নেই । এভাবে মানুষের সমগ্র জীবনই কর্ম নিয়মের দ্বারা গ্রথিত । বিজ্ঞানের ভাষায় অতীত কর্ম দ্বারা বর্তমান জীবন এবং বর্তমান কর্মদ্বারা ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত । বুদ্ধ জন্মতত্ত্বে এই সংজ্ঞাটির হুবুহু উল্লেখ করেছেন যেমন মানুষের পুর্বজন্ম দ্বারা বর্তমান জীবন আর বর্তমান জন্ম দ্বারা ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত হবে ।

পন্ডিত টেইলার তাঁর Primitive Culture গ্রন্থে বলেছেন, " বুদ্ধের প্রচারিত কর্মফল যা প্রাণী জগতের নিয়ন্ত্রন করে , শাস্তি বা পুরষ্কার বিচারের ফল নহে, কার্যকারন শৃংখলে অতীত কর্ম বর্তমান ফল প্রসব করে, বর্তমান মুহুর্তের কর্ম পরবর্তী মুহুর্তের ফল প্রসব করবে । এটা পৃথিবীর নীতি বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য আবিষ্কার" ।

আধুনিক বিজ্ঞান বিশ্বে শাশ্বত ( Fixed) বলে কোন জিনিস আবিষ্কার করতে অদ্যবদি পারেনি । আপাতদৃষ্টিতে কোন কিছু স্থায়ী মনে হলেও আসলে তা স্থায়ী নয় - ধ্বংস তার অনীবার্য । বুদ্ধের অনিত্যবাদ মতবাদে এর সম্পুর্ন মিল রয়েছে যেমন পৃরথিবীতে কোন কিছু স্থির নেই , সবকিছুই প্রবাহমানতার স্রোতে ধাবমান । প্রাকৃতিক ঘটনাপুঞ্জ চির প্রবাহমান এবং নিত্য পরিবর্তনশীল । এখানে চিরস্থায়ী অপরিবর্তনীয় বলতে কিছুই নেই । বুদ্ধের এই মতবাদকে বিজ্ঞানি ও দার্শনিকগন বহুকাল পর সামর্থন করেছেন । গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস ও ফরাসী দার্শনিক বেগস বুদ্ধের অনিত্যতাবাদকে স্বীকার করেছেন । তাঁদের মতে জগতের সমস্ত প্রানী ও বস্তুসমুহ ধবংশীল চিরস্থায়ী বলতে কিছুই নেই আবার ব্যাক্তিস্বত্ত্বার অভ্যন্তরে চিরন্তন আত্মা বলতে কিছুই নেই । বুদ্ধ মানব শরীরকে আধুনিক সার্জনের ন্যায় বিশ্লেষণ করে বলেছেন - পঞ্চস্কন্ধ ও মন সম্বলিত দেহে শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়ার প্রবাহ ব্যাতীত কোন শাশ্বত আত্মা বলতে কিছুই নেই । বিজ্ঞান হিসেবে এই ধর্ম মানুষের প্রকৃতি নিয়ন্ত্রন ও জীবন প্রণালী উদ্ভাবন করেছে পঞ্চস্কন্ধ নামক সত্য আবিষ্কার দ্বারা। দার্শনিক হিউম, উইলিয়াম জেমস, ব্রাট্রান্ড রাসেল, অধ্যাপক হোন্ড, এইচ টি কুলরুক, মনোবিজ্ঞানী বল্ডুইন, প্রমুখ আধুনিক কালের প্রখ্যাত দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মণীষীবৃন্দ বুদ্ধের এই মৌলিক মতবাদকে স্বীকার করে নিয়েছেন । আত্মাবাদ আধুনিক কালের বিজ্ঞানের গতিবাদের পুর্বসংস্করন।

এই যুগে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের প্রচেষ্ঠা যথেষ্ট চালানো হচ্ছে । তবুও উভয়ের মাঝে সংঘাতের নানা কারন ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৌদ্ধধর্ম প্রথম থেকেই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে ও যুক্তি তর্কের মাধ্যমে নৈতিক ও ব্যাবহারিক সত্যগুলোকে যাচাই করে নিয়েছে বলে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে এক আচশার্য সমন্বয় সাধন করতে পেরেছে , আর বিশ্বভ্রম্মান্ডে বৌদ্ধোধর্ম হয়ে উঠেছে মহাজাগতিক ধর্ম। বুদ্ধ তাঁর দীর্ঘকালের গবেষনার দ্বারা ভ্রান্তি নিরসনের মাধ্যমে প্রত্যেকটা মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । বৌদ্ধধর্ম ও বিজ্ঞানের এই স্বার্থক সমন্বয় পৃথিবীর ভাবীকালের স্বপ্ন ও সাধনা , আশা-আখাংকা ও স্বার্থকতা। এর সার্থক প্রয়োগ হলেই মহামৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হবে বিশ্বশান্তি ও মহামুক্তির পথ সুগম হবে।

সহায়ক গ্রন্থ এবং মতবাদ সমুহঃ
১. প্রতীত্য সমুৎপাদ
২. মধ্যম পন্থা ( Middle View)
৩. চারি আর্য্য সত্য ( Four Noble Truth )
৪.শমথ ও বিদর্শন ভাবনানীতি (The Principle of Striven )
৫. সপ্ত বোধঙ্গ বা বোধি অঙ্গ
৬. ধর্মীয় স্তোত্র (Hymns of the Faith) by আলবার্ট জে এডমন্ডস
৭. বুদ্ধের পুণ্যপদ( The Buddha's Way of virtue) by পণ্ডিত কে জে সান্ডার্স
৮. কার্য কারন সম্পর্ক (Casual Relation )
৯.নিত্যবাদ ( Eternalism)
১০. উচ্ছেদবাদ (Nihilism)
১১. বৌদ্ধদর্শন ও বিজ্ঞান by ড. দীজেন বড়ুয়া
12. Cosmical Science (মহাজাগতিক বিজ্ঞান) by Einstein


তথ্য সুত্র : "মহাবৌধি " সাময়িকী



রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৫



পুণ্যকর্ম কেন পুনঃ পুনঃ করা উচিত?
============================


এই গৌতমবুদ্ধের সময় রাজগৃহে এক দরিদ্রা স্ত্রী লাজ বিক্রয করে জীবন-যাপন করত। রাজগৃহে ‘পিপ্পলি গুহা’ নামে এক গুহা ছিল। মহাকশ্যপ যখন রাজগৃহে অবস্থান করেন তখন সেই গুহাতেই অবস্থান করতেন। একসময় তিনি সপ্তাহকাল নিরোধ-সমাপত্তিতে নিমগ্ন হন। সেই সমাপত্তি হতে উঠে কোন অভাগাকে তিনি অনুকম্পা করবেন চিন্তা করতে থাকেন। তাঁর করুণাজালে ঐ দুঃখী রমণীই পতিত হয়। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে তিনি সেই দুঃখিনীর নিকট উপস্থিত হন। সেও প্রসন্ন চিত্তে তাঁর পাত্র পরিপূর্ণ করে খৈ দান করে প্রার্থনা করে- ‘এই পুণ্যপ্রভাবে আমি যেন আপনার দৃষ্টধর্মের ভাগী হই।'
.
যথাসময়ে সেই নারীর মৃত্যু হলে ঐ দানময় পুণ্যপ্রভাবে সে ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গে ‘লাজ দেবকন্যা’ নামে উৎপন্ন হয়। তাঁর সেই বিপুল দিব্যসম্পত্তি লাভের হেতু মহাকশ্যপকে দানের ফল জেনে তাঁর লব্ধ সম্পত্তি স্থায়ী করবার ইচ্ছায় শেষরাতে সোনার ঝাড়– ও ঝুড়ি নিয়ে পিপ্পলিগুহার অঙ্গন পরিষ্কার করেন এবং পানীয় ও ব্যবহারের জল তুলে দেন। সকালে মহাকশ্যপ স্থবির তা দেখে মনে করেন কোন তরুণ ভিক্ষু বা শ্রামণ হয়ত এ ব্রত করেছে। তৃতীয় দিন শেষরাতে দিব্যজ্যোতিতে বিভূষিতা দেবকন্যাকে সেকাজ করতে দেখে তিনি বারণ করেন। দেবকন্যা নিজের পুণ্যসম্পদ অর্জনের জন্য সেই সেবাকাজে অনুমতি দেবার জন্য স্থবিরকে পুনঃপুন প্রার্থনা করেন। দেবকন্যার সেবা গ্রহণ ভিক্ষুর পক্ষে অনুচিত বলে তিনি অস্বীকার করেন। তথাপি বারবার অনুনয়-বিনয় করায় তিনি তুড়ি প্রহার করেন। দেবকন্যা চলে যেতে বাধ্য হন। যাবার সময় আকাশে স্থিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা করেন- ‘ভন্তে আমার লব্ধসম্পত্তি বিনাশ করবেন না। তা স্থায়ী করতে আমাকে অবকাশ দিন।’
.
ভগবান সুদূর জেতবন হতে দেবকন্যার কান্না শুনে বুদ্ধরশ্মি বিচ্ছুরিত করে দেবকন্যাকে উপদেশ দেন- ‘দেবতে! আমার পুত্র মহাকশ্যপের সংযম রক্ষা করা কর্তব্য। সুখকামীদের কিন্তু পুণ্যসম্পদ সঞ্চয় করা উচিত। তৎপর বুদ্ধ বলেন- পুণ্যকর্ম মানুষের পুনঃপুন করা উচিত এবং তার জন্য ইচ্ছা উৎপন্ন ও বর্ধন করা কর্তব্য। কারণ পুণ্যই জন্মজন্মান্তরে সর্বসুখের উৎস।
.
বুদ্ধের সেই ধর্ম শুনে ঐ দেবকন্যা স্রোতাপন্না হন। ঐ ধর্মদেশনা বহু দেবব্রহ্মার মহামঙ্গলদায়ক হয়েছিল।
.
সূত্রঃ [মহামংগল]

বুধবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৫



শীল বিশুদ্ধিই নির্বাণের ভিত্তি
***************************
আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় বৌদ্ধদের পবিত্র সংযম
সাধনা ও পুণ্য-পারমী পূর্ণ করার সময় অর্থাৎ ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস। বৌদ্ধিক রীতি ও প্রথা অনুসারে বৌদ্ধরা তিন মাস বর্ষাবাসের সময় শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলনের মাধ্যমে কুশলকর্ম সম্পাদন করে পারমী পূর্ণ করেন। তাই বর্ষাবাসের প্রারম্ভে শীল পালনের প্রয়োজনীয়তা ও শীল পালন বা রক্ষার ফল সমূহ জ্ঞাত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
নিম্নে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হল-
শীল হল সকল কুশল কর্মের ভিত্তি। বৌদ্ধ মাত্রই পঞ্চশীল পালন করা আবশ্যক। ধর্মময় উৎকৃষ্ট জীবন গঠনের নিমিত্তে অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে সারা বছর শীল পালন করা উচিত। তথাপি যাদের পক্ষে সম্ভব নয় তাদের অন্তত তিন মাস বর্ষাবাস সময়ে পালন করা একান্তই কর্তব্য। তাই দুর্লভ মানব জন্মকে আলস্য, অবহেলায় নষ্ট না করে শীল পালন ও অনুশীলনের মাধ্যমে ক্রমশ আত্মমুক্তি অর্থাৎ
নির্বাণের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত।
শীলের অর্থ
***********
শীল শব্দের অর্থ শীলন বা সমাধান বা সুনীতির
দ্বারা কায়িক, বাচনিক ও মানসিক কর্মে সংযম। শীল শব্দের আভিধানিক অর্থ স্বভাব, প্রকৃতি, প্রকার, ভাব, চরিত্র, ধর্ম, সত্যের উপযোগিতা, শারীরিক বা মানসিক গঠন, অভ্যাস, রীতি, ব্যক্তি বা বস্তুর বিশিষ্ট ধর্ম বা গুণ, খ্যাতি, নাম ব্যবহার, আচরণ, চাল-চলন, অন্যের প্রতি ব্যবহার, সচ্চরিত্র,
সদাচার, সৎস্বভাব, নৈতিকতার নিয়মাবলী, ধর্মাচরণের সংহিতা, ধর্মসম্মত অভ্যাস হওয়া অথবা শীল অর্থে উপধারণ, কুশলকর্ম সমূহের প্রতিষ্ঠা বা আধার। যার দ্বারা মনের পরিদাহ নির্বাপিত হয়ে শীতল হয় তাই শীল। বিচ্ছিন্ন শির- প্রাণী যেমন মৃত, শীলবিহীন দুঃশীল ব্যক্তিও তেমন মৃতপ্রায়।
এই অর্থে শীলের অপর নাম “শির”। শীলের মধ্যে সমস্ত কুশল ধর্ম প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয় লাভে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এই অর্থে শীলের অপর নাম “প্রতিষ্ঠা”। শীলের
সংস্পর্শে কায়িক-বাচনিক-মানসিক বিশৃঙ্খলা দূরীভূত
হয়ে ইন্দ্রিয় সংযম সুসংযত হয়। এই অর্থে শীলের অপর নাম “দমনগুণ”। তাই শীল হল সদাচারগুলোকে ভালভাবে রক্ষা করা ও পালন করা। কায়িক-বাচনিক ও মানসিক কর্মগুলো যাতে এলোমেলো না হয় সেজন্য
সুন্দরভাবে তা রক্ষা করতে হবে।
শীল কত প্রকার
***************
শীলকে ত্রিপিটক গ্রন্থে বিভিন্ন প্রকারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
১। পঞ্চশীল,
২। উপোসথ অষ্টশীল,
৩। মিথ্যাজীব সমথ অষ্টশীল,
৪। দশ সুচরিত শীল,
৫। প্রব্রজ্যা দশশীল,
৬। পটিজাগর উপোসথ শীল,
৭। পটিহারিয় উপোসথ শীল,
৮। চর্তুপরিশুদ্ধিশীল,
৯। ধূতাঙ্গশীল ও
১০। ভিক্ষুশীল
উপরোক্ত আলোচনা ভেদে শীল দশ প্রকার।উপরে উল্লেখিত দশ প্রকার শীলের মধ্যে পঞ্চশীল ও অষ্টশীল সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোকপাত করব।
মিথ্যাজীব শমথ অষ্টশীল ও দশ সুচরিত শীল পঞ্চশীল গৃহীদের নিত্য পালনীয় শীল। ধর্মময় উৎকৃষ্ট জীবন গঠনের নিমিত্তে উপোসথ অষ্টশীলের প্রবর্তন করেছেন সম্যক সম্বুদ্ধ। যারা উপোসথশীল পালনে অক্ষম তারা মিথ্যাজীব শমথ অষ্টশীল ও দশ সুচরিতশীল পালনে নিজের চিত্তকে বিনম্র রেখে পুণ্য স্রোতে পরিচালিত করতে পারেন। সত্য-ব্রতের মাধ্যমে বিকাশ প্রাপ্ত হয়। ভদ্রতা-সভ্যতা আরও বহুবিধ
সৎগুণাবলী। তৎসঙ্গে সুষ্ঠুভাবে রক্ষিত হয় পঞ্চশীল। পরম হিতাবহ দ্বিবিধ শীল নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল।
মিথ্যাজীব শমথ অষ্টশীল
*************************
১নং হতে ৫নং পর্যন্ত পঞ্চশীলের ব্যাখ্যার ন্যায়।
৬। পিসুন বাচা ও ফরুসবাচা বেরমণী অর্থাৎ পরস্পর বিচ্ছেদজনক ভেদবাক্য, কর্কশ ও নিন্দা তিরস্কারাদি পরের মনোকষ্ট দায়ক বাক্য ভাষণ হতে বিরত থাকা।
৭। সম্ফপ্পলাপা অর্থাৎ সম্প্রলাপ বা যা বক্তা ও শ্রোতার কোনই উপকার হয়না, তেমন বৃথা বাক্য না বলা বা বিরত থাকা।
৮। মিচ্ছজীব অর্থাৎ মিথ্যাজীব অস্ত্র, প্রানী, মাংস, নেশা ও বিষ এই পঞ্চ বাণিজ্য এবং অসুদপায় জীবন যাপন হতে বিরত থাকা।
দশ সুচরিতশীল
***************
১নং হতে ৭নং পর্যন্ত মিথ্যাজীব শমথ অষ্টশীলের ব্যাখ্যার
ন্যায়।
৮। অভিজ্ঝা অর্থাৎ পরের সম্পত্তিতে লোভ ও
তা স্বীয় আয়ত্তে আনবার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা।
৯। ব্যাপাদ অর্থাৎ পরের প্রতি হিংসা, ক্রোধ অর্থাৎ মনে মনেও অন্যের অনিষ্ট চিন্তা ও অন্যের প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ হতে বিরত থাকা।
১০। মিচ্ছাদিটিঠিয়া বা মিথ্যাদৃষ্টি হতে বিরত থাকা।
গৃহী দশশীল
*************
১নং হতে ৯নং পর্যন্ত অষ্টাঙ্গ উপোসথ শীলের ন্যায়।
১০। জাত-রূপ-রজত পাটিগ¹হনা বা স্বর্ণ-রৌপ্য প্রচলিত টাকা পয়সা গ্রহণ হতে বিরত থাকা। ( গৃহী দশশীল প্রতিপালন করা গৃহীদের শ্রদ্ধা ও উৎসাহের উপর নির্ভর করে।
প্রব্রজ্যা দশশীল
***************
এই প্রব্রজ্যা দশশীলও গৃহী দশশীলের ব্যাখ্যার অনুরূপ। এই প্রব্রজ্যাশীল প্রত্যেকটি সিক্খাপদং পর্যন্ত বলে সর্বশেষ ইমানি পব্বজা সামণের দসসিক্খাপদানি সমাদিয়ামি এই পদটি ২য় ৩য় বার বললে প্রব্যজ্যাশীল গ্রহণ করা হয়।
চারি পরিশুদ্ধিশীল
******************
প্রাতিমোক্ষ সংবর, ইন্দ্রিয় সংবর, আজীব পরিশুদ্ধি ও প্রত্যয় সন্নিশ্রিত শীল ভেদে শীল চার প্রকার।
১। প্রাতিমোক্ষ সংবরশীল: চারিত্রশীল ও বারিত্রশীল
ভেদে ২২৭ প্রকার শিক্ষাপদগুলোকে পালন করা।
২। ইন্দ্রিয় সংবরশীল: চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, কায় ও মন এই ষড়েন্দ্রিয় অকুশল কর্ম উৎপন্ন না হয় মত
স্মৃতি দ্বারা রক্ষা করাই ইন্দ্রিয় সংবরশীল।
৩। আজীব পরিশুদ্ধিশীল: কায় বাক্য সম্পাদিত
প্রাণীহত্যাদি সপ্তবিধ অকুশল কর্ম বা ইন্দ্রজাল ও ছলনাপূর্ণ অলীক বাক্য ইত্যাদি গর্হিত উপরের লাভ সৎকার উৎপাদনে বিরত থেকে ধর্মতঃ লব্ধ
চর্তুপ্রত্যয়ে জীবিকা নির্বাহ করার নাম আজীব
পরিশুদ্ধি শীল।
৪। প্রত্যয় সন্নিশ্রিতশীল: ধর্মত উৎপন্ন চারি প্রত্যয় লোভ, দ্বেষ ও মোহ উৎপাদন না করে অল্পে সন্তুষ্ট হওয়া এবং অধিক লাভের ইচ্ছায় যাচঞা না করা, একে প্রত্যয় সন্নিশ্রিতশীল বলে।
ধুতাঙ্গশীল
***********
অল্প ইচ্ছা ও যথালাভে সন্তুষ্টি গুণযুক্ত শীলই ধুতাঙ্গশীল। এই ধুতাঙ্গশীল অল্পেচ্ছা, সন্তষ্টি ও তৃষ্ণাদির লঘুতা সম্পাদনকারী। প্রবিবেক মুক্ত, বীর্যারাম্ভ ও সুব্রতাদি গুণ সলিল দ্বারা দুঃশীল মন বিধৌত করে সুপরিশুদ্ধ শীলে প্রতিস্থাপিত করায়। তদ্ধেতু সম্যক সম্বুদ্ধ লোকামিশ পরিত্যাগে মনোযোগী দেহ ও জীবনের প্রতি অনপেক্ষ নির্বাণকামী ভিক্ষুদের জন্য তের প্রকার ধুতাঙ্গশীলের অনুজ্ঞা করেছেন।
আবার প্রতিসম্ভিদা গ্রন্থে শীলকে নিম্নরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
১) চেতনাশীল,
২) বিরতীশীল,
৩) চৈতসিকশীল,
৪) সংবরশীল, ও
৫) অব্যতিক্রমশীল।
১। চেতনাশীল : প্রাণীহত্যা, চুরি, কামাচার, মিথ্যাবলা,
বিভেদ বাক্য বলা, কর্কশ বাক্য বলা, অর্থহীন বাক্য
বলা থেকে বিরত থাকার চেতনাকেই চেতনাশীল
বলা হয়ে থাকে।
২। বিরতীশীল : কায়িক, বাচনিক (সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক আজীব) অকুশল কর্ম থেকে বিরত থাকাকে বিরতীশীল বলে।
৩। চৈতসিকশীল : অভিধ্যা পরিত্যাগ করে অভিধ্যা বিগত চিত্তে বিহার করে ইত্যাদিক্রমে উক্ত অনভিধ্যা, অব্যাপাদ ও সম্যক দৃষ্টি ধর্ম চৈতসিকশীল (এদের অলোভ, অদ্বেষ, অমোহ চৈতসিকও বলা হয়)।
৪। সংবরশীল : ভিক্ষুগণের শীল পালনকে ‘সংবর’ বলে। ভিক্ষুগণের সাথেই বিশেষভাবে সম্পর্কিত এই সংবরশীল পাঁচ প্রকার।
১। প্রাতিমোক্ষ সংবর শীল : ২২৭ প্রকার
শিক্ষাপদগুলোকে মেনে চলা বা পালন করা।
২। স্মৃতি বা ইন্দ্রিয় সংবর শীল : রূপ, শব্দ, গন্ধ,রস, স্পর্শ ও ধর্ম এই ষড়বিধ আরম্মণের প্রতি অনিষ্টকর চিন্তার উৎপন্ন স্বরূপ। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, কায় ও মন নামক ষড়েন্দ্রিয়ে অকুশল প্রবেশ করতে না পারে মত স্মৃতি দ্বারা রক্ষা করাই হল ইন্দ্রিয় সংবরশীল।
৩। জ্ঞান সংবরশীল : জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা রক্ষা করা। তৃষ্ণা, মান, দিটঠি(দৃষ্টি), অবিদ্যা,ক্লেশ ধর্মগুলো
যাতে বৃদ্ধি না হয় সেভাবে জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা রক্ষা করা।
চর্তুপ্রত্যয় ব্যবহারে যাতে ক্লেশ উৎপন্ন না হয়
সেভাবে প্রজ্ঞার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ(প্রত্যবেক্ষণ)
করে ব্যবহার করা।
৪। ক্ষান্তি সংবরশীল : শীত বা উষ্ণ ইত্যাদিকে সহ্য
করে অকুশলধর্ম বৃদ্ধি না হয় মত রক্ষা করাই
ক্ষান্তি সংবরশীল।
৫। বীর্য্য সংবর : কামগুণ সম্পর্কিত চিন্তা, অপরের অনিষ্টকর চিন্তার উৎপন্ন হিংসা ও বিপরীত চিন্তা
দ্বারা প্রমাদভাব যাতে উৎপন্ন না হয় সেজন্য বীর্য্য
সহকারে পালন করা। বিশেষকরে আজীব পরিশুদ্ধও এর অর্ন্তভুক্ত অর্থাৎ সৎজীবিকা দ্বারা জীবন নির্বাহ করার জন্য বীর্য দ্বারা রক্ষা করা।
৬। অব্যতীক্রমশীল : গ্রহণ কৃত শিক্ষাপদগুলোকে কায়িক- বাচনিক দ্বারা অনতিক্রমকে অব্যতীক্রমশীল বলা হয়। বিশুদ্ধি মার্গ গ্রন্থে নিম্নোক্তভাবে শীলকে দেখানো হয়েছে।
চারিত্র ও বারিত্রশীল :
********************
যা ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক কর্তব্য বলে প্রজ্ঞাপ্ত হয়েছে সেসব শিক্ষাপদ পূরণ করাই চারিত্রশীল অর্থাৎ চারিত্র হল স্বভাব, চরিত্র, দেশাচার, দেশের প্রথা বা রীতি, আচরণ, নৈতিকতার নিয়ম, কর্তব্য বিষয়ক জ্ঞানের পদ্ধতি, ধর্মাচরণের নীতি, ধর্মের নিয়মাবলী এগুলোই হল চারিত্রশীল। সিঙ্গালোবাদ সূত্রে ভগবান বুদ্ধের দেশিত ছেলেমেয়েদের কর্তব্য, মাতাপিতার কর্তব্য, শিষ্যের কর্তব্য, গুরুর কর্তব্য, স্বামীর কর্তব্য ও স্ত্রীর কর্তব্য ইত্যাদি চারিত্রশীল। শ্রদ্ধা ও বীর্য সহকারে আচরীত ধর্মগুলোকে আচরণ করলেই চারিত্রশীল পরিপূর্ণ হয়।ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক অকর্তব্য বলে যেগুলোকে নিষেধ বা বারণ করা হয়েছে সেগুলো বারিত্রশীল অর্থাৎ কায়িক, বাচনিক দুশ্চরিত্র কার্য থেকে বিরত থাকা।বারিত্রশীল নামক পঞ্চশীলকে দেবলোক গমনের ও নিবার্ণ প্রাপ্তির কুশল কর্মপথ বলা হয়।চারিত্রশীল পরিপূর্ণ পালনকারী ব্যক্তি বারিত্রশীল নামক অকুশল, দুশ্চরিত কার্যগুলো থেকে বিরত থাকতে পারে।
এছাড়াও যেসব শীল সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে নিম্নে সেগুলোর নাম উল্লেখ করা হল-
দ্বিবিধ প্রকারে - আভিসমাচারিক ও আদিব্রহ্মচার্য্যিক,
বিরতি ও অবিরতি, নিশ্রিত ও অনিশ্রিত, কার্য পযর্ন্ত ও
আপ্রাণকোটি , সপর্যন্ত ও অপর্যন্ত, লৌকিক ও লোকোত্তর ভেদে দ্বিবিধ।
ত্রিবিধ প্রকারে - হীন, মধ্যম ও প্রণীত উৎকৃষ্ট:
আত্মাধিপত্যেয়, লোকাধিপত্যেয়, ধর্মাধিপত্যেয়:ভেদে:
পরামৃষ্ট, অপরামৃষ্ট, প্রতিপ্রস্রদ্ধি ভেদে: বিশুদ্ধ, অবিশুদ্ধ, বৈমতিক বশে এবং শৈক্ষ্য, অশৈক্ষ্য, নৈবশৈক্ষ্য না শৈক্ষ্য ভেদে ত্রিবিধ।
চর্তুবিধ প্রকারে - হানি ভাগীয়, স্থিতিভাগীয়, বিশেষ
ভাগীয়, নির্বেধভাগীয় ভেদে: তথা ভিক্ষু, ভিক্ষুণী,
অনুপসম্পন্ন, গৃহস্থশীল ভেদে: প্রকৃতি, আচার, ধর্মতা,
পূর্বহেতুকশীল বশে: এবং প্রাতিমোক্ষ সংবর, ইন্দ্রিয় সংবর, আজীব পরিশুদ্ধি ও প্রত্যয় সন্নিশ্রিত শীল ভেদে চর্তুবিধ।
পঞ্চবিধ প্রকারে - পর্যন্ত পরিশুদ্ধি শীলাদি ভেদে পর্যন্ত
পরিশুদ্ধি শীল, অপর্যন্ত পরিশুদ্ধি শীল, পরিপূর্ণ
পরিশুদ্ধিশীল, অপরামৃষ্ট পরিশুদ্ধি শীল, প্রতিপ্রস্রদ্ধি
পরিশুদ্ধি শীল।
তথা প্রহাণ, বেরমণী, চেতনা, সংবর ও অব্যতিক্রম ভেদে শীলসমুহকে বর্ণনা করা হয়েছে।
শীল পালনের প্রয়োজনীয়তা
**************************
প্রব্রজিত হোক বা গৃহী হোক প্রত্যেকের শীল পালন
করা একান্তই কর্তব্য। সুবিশুদ্ধ শীল বা শুদ্ধ চরিত্রই কুশল ধর্মের আদি। বস্তুর চারিত্রিক শুদ্ধতাই ধর্মচর্যার ভিত্তি। চরিত্র শুদ্ধ, সুন্দর না হলে অধ্যাত্ম জীবনের বিকাশ হয় না। পতিত জমি আবাদ করে সোনার ফসল ফলাতে হলে যেমন প্রথমেই আগাছা তুলে ফেলে জমি পরিষ্করা করতে হয় তেমনি আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা লাভের জন্য সর্বাগ্রে দুঃশীলতা,
দুর্নীতি বিদূরিত করে চরিত্র শোধন আবশ্যক। চৈতসিক হিংসার দ্বারা প্রাণী হত্যা করা হয়। চৈতসিক লোভের দ্বারা চুরি, ব্যভিচার ও নেশা পান এবং মোহ চিত্ত দ্বারা মিথ্যা বলা হয়। এসব অকুশলের শাখা - প্রশাখা তুল্য পাপে নির্লজ্জতা, নির্ভয়তা, উগ্রতা, অভিমান, ভ্রান্ত ধারণা, ঈর্ষা, কৃপণতা, অনুতাপ ও তন্দ্রালস্যতা প্রভৃতি অকুশল কর্মের জনক। এতে হৃদয়াশ্রিত শোণিত কৃষ্ণবর্ণ হয়ে শরীর ও মন
দূষিত করে। সুতরাং দূষিত মনে যেকোন কর্মই করুক না কেন, সেই কর্মের বিপাক হবে দুঃখপূর্ণ । তাই বিশুদ্ধভাবে শীল পালন করা অত্যাবশ্যকীয়। শুদ্ধ চরিত্রতার সুফল অনেক। মধ্যম নিকায়ের আকঙখেয্য সূত্রে ও অন্যত্র শীল পালনের বিবিধ গুণ বর্ণিত হয়েছে। শীল পালন না করলে ভিক্ষু ভিক্ষু নয়, ভিক্ষুণী ভিক্ষুণী নয়, উপাসক উপাসক নয়, উপাসিকা উপাসিকা নয়। এক কথায় বুদ্ধ শাসনে শীলহীন
দুশ্চরিত্রের স্থান নেই। সেইজন্য শীল হল এক চক্ষুহীনের অপর চক্ষুর ন্যায়, কিকী পক্ষীর ডিম্বের ন্যায় ও চামরী গাভীর পুচ্ছের(লেজ) ন্যায়,মাতা যেমন একমাত্র প্রিয় পুত্রকে জীবন দিয়ে রক্ষা করে তদ্রুপ শীলকেও সেভাবে রক্ষা করা প্রত্যেকেরই অপরিহার্য্য কর্তব্য। যে শীল।পালন ব্যতীত বুদ্ধ শাসনে কুলপুত্রদের প্রতিষ্ঠা নেই তাকে রক্ষা করাই একান্ত উচিত। বুদ্ধ বলেছেন, নিম্নবাহিনী গঙ্গা, যমুনা, সরভু, সরস্বতী, অচিরবতী ও মহী প্রভৃতি মহানদীর বারিরাশি সত্ত্বগণের যে পাপমল বিশোধন করতে পারে না, শীলজল তা একান্তই বিশোধন করে। জলসিক্ত শীতল বায়ু, রক্তচন্দন, মণিহার ও চন্দ্রকিরণ
সত্ত্বগণের যে অর্ন্তদাহ প্রশমিত করতে পারে না, সুরক্ষিত সুশীতল আর্যশীল বা শুদ্ধ শীল তা প্রশমিত করতে পারে।
শীলের সুবাসের মত সুবাস কোথায়, যা বায়ুর অনুকূল ও প্রতিকূলে প্রবাহিত হয়। শীলের মত স্বর্গারোহনের সোপান অথবা নির্বাণ নগর প্রবেশের পাথেয় বা দ্বার স্বরূপ যা আর কোথায় আছে?
শীলভূষণ ভূষিত ভিক্ষুগণ যে শোভা ধারণ করেন, তেমন শোভা মনিমুক্তা বিভূষিত রাজগণেরও পরিলক্ষিত হয় না। শীল সর্বদা সর্বতোভাবে শীলবান ব্যক্তির নিন্দাবাদাদি ভয় বিনষ্ট করে এবং তার নাম-যশ ও আনন্দ।উৎপাদন করে।এই শীল কোন শ্রাবক বা ঋষি ভাষিত নয়।।স্বয়ং বুদ্ধই সর্বজ্ঞতা জ্ঞানে শীলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে প্রজ্ঞাপ্ত করেছেন। তাই শীল পালনের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনাতীত।
শীলের আনিসংশ কি?
*********************
এক সময় ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বের হন। তিনি দেশ-দেশান্তরে পরিভ্রমণের পর নালন্দা হয়ে “পাটলী” গ্রামে উপস্থিত হন। তথায় উপাসক-উপাসিকাগণ উৎকৃষ্ট খাদ্য ভোজ্য দ্বারা বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে পূজা করেন।ভোজনান্তে বুদ্ধ তদ্দেশবাসী উপস্থিত জনসংঘকে ধর্মোপদেশ প্রসংগে শীলের গুণ বর্ণনা করেন। শীল পালনের যে কি ফল বা পুরুস্কার তা তিনি নিম্নোক্তরূপে প্রকাশ করেন।
(১) ভোগক্খন্ধ আনিশংস “হে গৃহপতিগণ , ইহলোকে শীলবান সৎপুরুষগণ অপ্রমত্তভাবে শীল পালন করলে বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী হয়।
২) কিত্তিসদ্ধ আনিশংস, হে গৃহপতিগণ ,
শীলবানদের শীল পালনের মঙ্গলময় সুর্কীতি সর্বত্র প্রচারিত হয়।
৩) বিসারদ আনিশংস হে গৃহপতিগণ, শীলবানগণ
যে যে পরিষদে গমন করে-যথা ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি ও শ্রমণ-পরিষদে উপস্থিত হন, তথায় তাঁরা নির্ভয়ে,
নিঃসংঙ্কোচে ও প্রফুল্ল চিত্তে উপস্থিত হতে পারেন।
৪) অসম্মূঢো কালং করোতি, হে গৃহপতিগণ, শীলবানদের শীল পালন হেতু মৃত্যুকালে চিত্ত বিভ্রম না হয়ে সজ্ঞানে মৃত্যুবরন করে।
৫) সৎ লোকং উপ্পজ্জতি, হে গৃহপতিগণ, শীলবানগণ
শীল পালনের ফলে দেহ-ত্যাগের পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হন।
হে গৃহপতিগণ শীলবানেরা শীল পালনের ফলে এই পাঁচটি ফল লাভ করে থাকেন”।। এছাড়াও শীল পালনের সুফল।বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
তাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মাত্রই সুচারুভাবে শ্রদ্ধা ও বীর্য
ধারণে শীল পালনের মাধ্যমে নিজ পুণ্য পারমী পূরণ
করে নির্বাণ লাভের চেষ্টা করা উচিত।
সংগৃহীত

বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৪

কঠিন চীবর দান কঠিন কেন ?



আমরা সবাই বলে থাকি কঠিন চীবর দান করব। আসলে আদৌ আমরা কখনো কি চিন্তা করে দেখি, কঠিন বলা হয় কেন? সারা বছর যে কোন সময় আমরা চীবর দান করে থাকি। তাহলে চীবর দান এবং কঠিন চীবর দানের মধ্যে পার্থক্য কি?
এবার জানব চীবরকে কঠিন বলা হয় কেন? চীবরের আগে কঠিন শব্দটি যুক্ত হলো কেন?
ভগবান বুদ্ধ প্রমুখ সাধু ব্যক্তিগণ উত্তম-উত্তম বলে প্রশংসা করেন, তাই কঠিন বলা হয়েছে। কঠিন চীবর দান কর্মকে সাধু সজ্জন, জ্ঞানী পন্ডিত ব্যক্তিগণ উত্তম বলে প্রশংসা করেন তাই এই দান কর্মকে কঠিন চীবর দান বলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন প্রশংসা করে কেন?
কঠিন চীবর দানকে তিনটি কারণে প্রশংসা করা হয়েছে।
১) কঠিন চীবর দান ---- সংঘদান হয় বলে,
২) কঠিন চীবর দান ---- বিশেষ সংঘদান হয় বলে,
৩) কঠিন চীবর দান ---- ভিক্ষুসংঘের পাঁচটি আপত্তি দূর করতে সক্ষম বলে।
কেন সংঘদান? ঃ
আমরা যখন কঠিন চীবর দান করি, তখন বলি -------
ভন্তে আমরা সংসারের সকল প্রকার বট্ট-দুঃখ মোচনের জন্য, পরমসুখ নির্বাণ দর্শন লাভের জন্য অত্র কঠিন চীবর ভিক্ষু সংঘকে দান করছি, পূজা করছি। কাকে দান করছি? ভিক্ষু সংঘকে। ভিক্ষু সংঘ বললে আমাদের ভগবান বুদ্ধসহ অতীত অতীত যতো ভগবান বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন আগামীতে যতো বুদ্ধ উৎপন্ন হবেন এবং অতীত, বর্তমান, অনাগত সকল ভগবান বুদ্ধকে ও তাঁদের সংঘকে উদ্দেশ্য করে দান দেওয়া হয়। তাই এই দান এতো বি¯তৃত, এতো বিশাল। তাই এ দানকে সাধু ব্যক্তিগণ প্রশংসা করেন বলেই এই দানটি কঠিন। কঠিন অর্থ স্থায়ী, গভীর, পাকাপোক্ত, পরম। যে পুণ্যের ক্ষয় নেই, যে পুণ্যের নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। ইহা একটি মহাসংঘ দান।
এই দান পুগগলিক দান নহে। তাই কঠিনচীবর দান সবার কর্তৃক প্রশংসিত। ভগবান বুদ্ধ সাংঘিক দানকে প্রশংসা করে বলেছেন ----- যিনি ভিক্ষু সংঘকে উদ্দেশ্য করে দান করেন, উক্ত দাতাগণ উত্তমভাবে দান করেছেন, উত্তমভাবে পূজা করেছেন বলা হয়। সংঘের নিকট প্রতিষ্ঠিত উক্ত দানকে মহাফল দায়ক মর্মে লোকবিদূ ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধগণ প্রশংসা করেছেন। সংঘকে দান করা শ্রেষ্ঠ দান হয়, প্রকৃত দান হয়।
বিশেষ সাংঘিক দান ঃ
শুধু সাংঘিক নয়, বিশেষ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। কেন বিশেষ সাংঘিক দান বলা হয়েছে?
১) ইহা একটি বিশেষ কালে দান (কাল)
২) কঠিন চীবর গ্রহণে উপযুক্ত ভিক্ষুকে দান দিতে হয় (পাত্র)
বিশেষ কাল-দান ঃ
কঠিন চীবর সারা বছর দান করা যায় না। বছরে মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে এই দান করা যায়। আশ্বিনী পূর্ণিমার পরবর্তী দিন থেকে শুরু করে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই ৩০ (ত্রিশ) দিন কঠিন চীবর দানের কাল। বিশেষ সময়কালে দান করতে হয় বলে তাকে কাল-দান বলা হয়।
উপযুক্ত ভিক্ষু কে? ঃ
যে ভিক্ষু বা ভিক্ষুগণ আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরবর্তী দিন থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই তিন মাস বর্ষাবাস ভঙ্গ করেননি, এইরূপ পুরিম (প্রথম) বর্ষাবাসকারী ভিক্ষুগণ কঠিন চীবর গ্রহণে উপযুক্ত।
যে সকল ভিক্ষু দ্বিতীয় বর্ষাবাস করবেন বা বর্ষাবাস ভঙ্গ করবেন তাঁরা কঠিন চীবর গ্রহণ করতে পারেন না। তাই ভগবান বুদ্ধ বলেছেন ----- ভিক্ষুগণ বর্ষাবাস থেকে উত্থিত হয়নি (বর্ষাবাস ভঙ্গ করেনি) ভিক্ষুগণকে কঠিন চীবর গ্রহণ করতে আমি বুদ্ধ অনুমতি প্রদান করছি বলে ভগবান বুদ্ধ আদেশ দিয়েছিলেন।
কঠিন চীবর দানের জন্য কাল ও পাত্র পাওয়া বড়ই দুর্লভ। তাই তা কঠিন এবং সাধুগণের দ্বারা প্রশংসিত।
ভিক্ষুগণের আপত্তি দূরকারী দান ঃ
কঠিন বলতে পাঁচটি সুফল অন্তঃকরণে সক্ষম বিধায় পাকাপোক্ত হয়। এখানে ভিক্ষুসংঘগণ পাঁচটি আপত্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারেন এই অর্থেও কঠিন বলা হয়েছে।
কঠিন চীবর দানের আরো একটি বিশেষত্ব ----- কঠিন চীবর বলতে অতি উৎকৃষ্ট হতে হয়। মাতার নিকট থেকেও চেয়ে নিতে পারে না। আকাশ থেকে আপনাআপনি (বৃষ্টির ফোটা) ঝরে পড়ার ন্যায় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত, অশ্র“ত, অদৃষ্ট চীবর হতে হয়। তখন কঠিন চীবর করা যায়। ইহা কঠিন চীবর দানের এক বিশেষত্ব হয়।
ভিক্ষু সংঘের কোন পাঁচটি আপত্তি দূর করে?
১। অনামন্তচার (অবগত না করে নিমন্ত্রণে গমন করা)
২। অসমাদানচার (ত্রি-চীবরের যাহা ইচ্ছা রেখে গমন)
৩। গণভোজন (গণভোজনে গমন)
৪। যাবদত্থচীবর (অধিষ্ঠান ব্যতিরেকে চীবর রাখা)
৫। যে বিহারের উদ্দেশ্যে দান হবে, সেই বিহারের সংঘগণ চীবরগুলোর মালিকানা দাবী করতে পারবেন।
কঠিন চীবর দানের উৎপত্তি ঃ
ভগবান বুদ্ধ শ্রাব¯তীর জেতবন বিহারে বাস করাকালীন কোশলরাজের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ত্রিশজন ভিক্ষুকে উদ্দেশ্য করে কঠিন চীবর দানের অনুমতি প্রদান করেছিলেন।
কোন এক সময় পাবেয়্যবাসী উক্ত ত্রিশজন ভিক্ষু পাবা নগর থেকে শ্রাবস্তীর জেতবনে ভগবান বুদ্ধের দর্শন লাভের উদ্দেশ্যে বের হয়ে আসেন। বর্ষাবাসের আর মাত্র দুই একদিন বাকী ছিলো। তাই তাঁরা শ্রাবস্তীতে পৌঁছতে না পেরে সাকেত শহরেই বর্ষাবাস যাপন করেন। বর্ষাবাস শেষ হলে ঐ ত্রিশজন ভিক্ষু ভগবান বুদ্ধের দর্শনে আসেন। তাঁদের পরনের চীবর ব্যতীত আর কোন অতিরিক্ত চীবর ছিলো না। ঐ একটি চীবরেই øান করতে হতো আবার শুকিয়ে গেলে গায়ে দিতে হতো। এভাবে রোদ বৃষ্টিতে ঐ এক জোড়া চীবর এক সময় ছিঁড়ে গিয়েছিলো এভাবে ছেঁড়া চীবর গায়ে দিয়েই অত্যন্ত ক্লান্ত অবসন্ন দেহে তাঁরা শ্রাবস্তীর জেতবনে ভগবান বুদ্ধের নিকট গমন করেন।

কঠিন চীবর দানের অনুমতি প্রদান ঃ
ভগবান বুদ্ধ চিন্তা করলেন -- আমি যদি কঠিনচীবরের অনুমতি দিতাম, তাহলে এ ভিক্ষুগণ দোয়াজিক খানি রেখে অন্য একটি পরিধান করে আসলে এতো কষ্ট পেতো না। কঠিনের অনুমতি পূর্বের বুদ্ধগণও প্রদান করেছেন তা দিব্য জ্ঞানে দর্শন করে ভগবান বুদ্ধ বললেন --- ভিক্ষুগণ সঠিকভাবে কোন দিন ভঙ্গ না করে প্রথম বর্ষাবাস পালনকারী ভিক্ষু কঠিন চীবর গ্রহণ করতে পারবে। আমি (বুদ্ধ) অনুমতি প্রদান করছি।
এভাবে ভগবান বুদ্ধ প্রথম কঠিনচীবর দানের ও গ্রহণের অনুমতি দিয়ে, দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের জন্য পূণ্য পারমী সঞ্চয়ের দুর্লভ সুযোগ দান করেন।
জগতের অন্যান্য দানে শুধুমাত্র দাতারাই দানের ফল প্রাপ্ত হন, গ্রহীতাগণ প্রাপ্ত হন না। কিন্তু এই কঠিন চীবর দানই একটি মাত্র আছে যে দানে দুই পক্ষই অর্থাৎ দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের মহাফল লাভ হয়। এই সকল বিবেচনা করেই ভগবান বুদ্ধ কঠিন চীবর দানের অনুমতি দিয়েছিলেন।
সর্বপ্রথম এই কঠিন চীবর দান করেন প্রধান উপাসিকা বিশাখা।
কঠিন চীবর দানের ফল ঃ
ত্রিচীবর(সংঘাটি, অর্ন্তবাস, উত্তরাসঙ্ঘ) এ তিনের যে কোন একটি চীবর দ্বারা কঠিন চীবর দান করা যেতে পারে। বুদ্ধ বলেছেন, জগতে প্রচলিত যত প্রকার দান আছে সর্বাপেক্ষা কঠিন চীবর দান হল দানের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এ দানের দ্বারা শ্রেষ্ঠ সর্বপ্রকার পূণ্য লাভ হয়। এই পৃথিবীতে যতপ্রকার দান আছে যা একখানা কঠিন চীবর দানের তুলনায় ঐ দানের ফল ষোল ভাগের একভাগও হয় না। একনিষ্ট ব্রক্ষ্মলোক পরিমাণ উচ্চ রৌপ্য পর্বত দান করলেও একখানা কঠিন চীবর দানের তুলনায় ঐ রৌপ্য পর্বত দানের ষোল ভাগের একভাগও হয় না।
অতীতকালে মহাকারুণিক শরণঙ্কর বুদ্ধের সময়ে ভগবান গৌতম বুদ্ধের অগ্রশ্রাবক”সারিপুত্র মহাস্থবির” এক রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম ছিল ”কম্বলরাজ কুমার”। যথাকালে তিনি রাজপদে অভিষিক্ত হলেন। একদিবসে কম্বলরাজ বিহারে গিয়ে বুদ্ধকে বন্দনা করে বললেন ------ ভান্তে, এখন আমরা কোন পুণ্য কর্ম সম্পাদন করব? বস্তুদানের মধ্যে যে দান সর্বোৎকৃষ্ট, সে দান সম্বন্ধে আমাদিগকে দেশনা করুন। তখন মহাকারুণিক শরণঙ্কর বুদ্ধ কঠিন চীবর দানের ফল বর্ণনা করে বললেন,
• যে ব্যক্তি সংঘকে কঠিন চীবর দানের জন্য বস্ত্র ক্রয় করে দেয় সে ব্যক্তি সর্বদা দেব মনুষ্যলোকে মহাধনী, মহাযশস্বী ও মহাভোগ সম্পদশালী হয়।
• যে ব্যক্তি সুতা তৈরী করে দেয় সে সর্বদা মুনষ্যলোকে সুখ ভোগ করে এবং সর্বদা সর্বকর্মে বিশারদ হয় ও কোন জন্মে কুজ হয় না।
• সংঘকে কঠিন চীবর দানের জন্য যে ব্যক্তি বস্ত্র ছেদন করে দেয়, সে জন্মে জন্মে ধর্মতঃ অর্থার্জনে পারদর্শী ও নিপুণ হয়।
• যে ব্যক্তি সংঘকে কঠিন চীবর সেলাইয়ের ব্যবস্থা করে দেয় সে মনুষ্যলোকে ঐশ্বর্যশালী ও মহাপ্রভাবশালী হয়। সে মনুষ্যলোক থেকে চ্যুত হয়ে দেবলোকে উৎপন্ন হয় এবং তথায় সর্বদা দেবগণের শ্রেষ্ঠ ঈশ্বর ও ঐশ্বর্যশালী দেবতা হয়ে তথায় সর্বদা সুখভোগ করে।
• যে ব্যক্তি সংঘকে কঠিন চীবর দান দেয়ার জন্য কঠিন চীবর সেলাই করে সে জন্মান্তরের সুরূপ হয়, মহাপ্রজ্ঞাবান এবং সর্বদা সুখলাভ করে। সে ভবে ভবে চর্তুদ্বীপের ঈশ্বর চক্রবর্ত্তী রাজা হয় এবং অসংখ্যবার প্রদেশের রাজত্ব প্রাপ্ত হয়। সেখান থেকে চ্যুত হয়ে দেবলোকে উৎপন্ন হয় এবং তথায় সর্বদা দিব্যসুখ ভোগ করে।
• যে ব্যক্তি সংঘকে কঠিন চীবর দান দেয়ার জন্য বস্ত্র রঞ্জন (রং) ও ধৌত কর্ম করে সে মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হলে সর্বদা সুখী ও নিরোগী হয়। সে সুবর্ণ শরীর লাভ করে এবং সুরূপ সর্বজনের চিত্ত প্রসাদকর প্রিয়দর্শন হয়। সে দেবলোকে উৎপন্ন হলে দেবগণের প্রিয় হয়।
• যে ব্যক্তি কঠিন চীবরের গ্রন্থী (গিরা) সুতা দান করে সে সর্বদা পরিশুদ্ধ অবস্থা সম্পন্ন হয়ে সংসরণ করে, অপায়ে উৎপন্ন হয় না।
• যে ব্যক্তি শ্রদ্ধার সাথে কঠিন চীবর ধৌত করে সে সুগতি প্রাপ্ত হয়। সর্বদা দেব-নরলোকে সুখী হয়। সে সর্বদা সগৌরবে পূজিত ও সৎকার প্রাপ্ত হয় এবং মহাযশস্বী মহাভোগসম্পদশালী ও দীর্ঘায়ু সম্পন্ন হয়। সে সর্বদা দেবলোকে দেববৃন্দের এবং মনুষ্যলোকে মনুষ্যদের শ্রেষ্ঠ হয়। এভাবে বুদ্ধ কঠিন চীবর দানের ফল ব্যাখ্যা করলেন।
বুদ্ধ ভাষিত দানের ব্যাখ্যায় কঠিন চীবর দানের ”উত্তম দান” এর ফল বর্ণনা করতে গিয়ে নাগিত স্থবির বলেছিলেন, আমি একবার মাত্র কঠিন চীবর দান দিয়ে কল্প হতে বিগত ত্রিশ কল্প পর্যন্ত দুর্গত অনুভব করি নাই। আঠার কল্প দেবলোক সুখভোগ করেছি, ছত্রিশ বার দেবরাজ দেবকুলে রাজত্ব করেছি, ক্ষত্রিয় ব্রাক্ষণ কুলে জন্মগ্রহণ করেছি। সুমেরু পর্বত প্রমাণ রাশি করে সংঘ মধ্য ত্রিচীবর দান একখানা কঠিন চীবর দানের পুণ্যের ষোল ভাগের এক ভাগ হয় না, চুরাশি হাজার বিহার নির্মাণ করে দান করলে কঠিন চীবর দানের সমান ফল হয় না।

পরিশেষে আমাদের চিন্তা করতে হবে এতো পুণ্য কাজ করার পরে আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে। কিভাবে? ভাবনার মাধ্যমে। শুধুমাত্র দান, শীলের মধ্যে থাকলে কোনদিন দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় যদি ভাবনা বিহীন থাকেন। দান, শীল নির্বাণে পৌঁছার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। পরিপূর্ণতা এনে দেবে ভাবনা। কারণ শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা এ তিনটা যদি না থাকে পরিপূর্ণতা নেই, নির্বাণ পাওয়া যাবে না। নির্বাণ যাওয়ার মার্গপথ হচ্ছে জ্ঞানে। মার্গজ্ঞান, ফলজ্ঞান ভাবনার মাধ্যমে উৎপন্ন করে দেখুন আপনার মধ্যে অনিত্য আছে। অনিত্যকে যদি আপনি একবার দর্শন করেন ইহাই বিদর্শণ। একবার যদি বিদর্শন জ্ঞান উৎপন্ন করতে পারেন অনিত্য দর্শনের মাধ্যমে আপনার জীবন হবে সার্থক। তাহলে পরবর্তী যে কোন এক জন্ম আপনি সম্পূর্ণভাবে অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম দর্শন করে চতুরার্য সত্য দর্শন করে অরহত্ত্ব মার্গফল লাভ করে নির্বাণ দর্শন করতে পারবেন।
পৃথিবীর সকল দেব, নাগ, ব্রক্ষ্মা, যক্ষ, অসুর, রাক্ষস, ভূত, প্রেত, সকল মনুষ্য, সকল অমনুষ্য, সকল হিংস্র জীবজন্তু, উপরে ভবাগ্রে থেকে নীচে অবীচি পর্যন্ত একত্রিশ লোকভূমির সকল সত্ত্বকে কায়-মনো-বাক্যে আমার সকল মৈত্রী এবং পুণ্যরাশি দান করছি। সকলেই আমার মৈত্রী এবং পুণ্যরাশি লাভ করিয়া শোকমুক্ত, রোগমুক্ত, দুঃখমুক্ত, ভয়মুক্ত, বিপদমুক্ত, অন্তরায়মুক্ত, উপদ্রববিহীন, শংকা এবং উদ্বিগ্নবিহীন হউক।
সকলের মঙ্গলময় মনষ্কামনা পরিপূর্ণ হউক। সকলের চিত্ত অন্তর সুখী হউক।

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪

[]> নরকের তালিকা থেকে আপনার নামটি মুছে ফেলুন <[]



মানবজন্ম বড় দুর্লভ। অনেক সাধনার বিনিময়ে আমরা মানব জীবন লাভ করে থাকি। কিন্তু আমরা অনেকেই দানরত না হয়ে, পোষদের দিনে শীল পালন না করে এবং ধর্মোপদেশ গ্রহণ না করে কেবল জাগতিক সুখে মত্ত থাকি। প্রকৃতপক্ষে সকল জাগতিক সুখ ও বস্তু সম্পদের চেয়ে একজন মানুষের মনই হচ্ছে অধিক মহার্ঘ। মূলত মনই হচ্ছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রধান সম্পদ বা সঞ্চিত ধন। সুতরাং মনকে ভালভাবে দেখাশুনা করা উচিত। মনের প্রকৃত স্বভাব উপলব্ধি করাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্মের উপলব্ধি। মনকে বুঝা মানে ধর্ম বুঝা। একইভাবে যিনি মনকে জানেন, তিনি সমগ্রভাবে ধর্ম জানেন। ত্রিলোকের সকল স্বত্তগন হচ্ছে মন দ্বারা গঠিত স্বত্ত(Mind made beings)। স্বর্গ ও নরকও মন দ্বারা সৃষ্ট। তাই নরকের তালিকা থেকে নামটি মুছে ফেলতে চাইলে সতত শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলনের মাধ্যমে জীবনের প্রীতিটি মুহূর্তকে অধিকতর মঙ্গলময় ও সার্থক করে তুলুন। কারণ প্রীতিটি মুহূর্তে জ্বরা, ব্যাধি এবং মৃত্যু আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যদি কোন কারণে নরকে পতিত হতে হয়, তাহলে আমাদের অস্থিত্বটাই ওখানে সাধারণ প্রাণীর চেয়েও নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে পড়বে। তাই অবিদ্যার অনুবর্তী না হয়ে এই বিষয় গভীরভাবে অনুধাবন করা উচিত। কারণ অবিদ্যারুপ মেঘ প্রজ্ঞারুপ আকাশকে আচ্ছন্ন করার ফলে অসারকে সার এবং নরকের ক্ষুরচক্রকেও স্বর্গের প্রস্ফুটিত শতদল মনে হয়। এ বিষয়ে চতুদ্বার জাতকে মিত্রবিন্দকের কাহিনী থেকে সুস্পষ্টভাবে বোধগম্য হওয়া যায়। মিত্রবিন্দক ছিলেন নিতান্ত দুঃশীলপরায়ণ। তিনি একদিন সঙ্কল্প করলেন যে, একটি নৌকা সংগ্রহ করে বাণিজ্য করবেন। তিনি তার মাতাকে জানালে মাতা তাঁকে না যাওয়ার জন্য নিবারণ করে তার হাত ধরে থাকলেন কিন্তু পাপাত্মা মাতার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাঁহাকে প্রহার করে ভুতলে ফেললেন এবং সেই মুহূর্তেই গৃহ থেকে বাহির হয়ে পোতারোহণে সমুদ্রযাত্রা করলেন। পাপাচার-বশত তার পোত সমুদ্রবক্ষে নিশ্চল হয়ে রইলেন। পোতারোহিগণ, তাহাদের মধ্যে কে কালকর্ণিক, তা নিরূপণ করার জন্য গুটিকাপাত করেল ইহা তিন বারই মিত্রবিন্দকের নামে নিপতিত হল। তখন তারা মিত্রবিন্দকের জন্য একটি ভেলক প্রস্তুত করে তাকে সমুদ্রে নামিয়ে দিলেন। মিত্রবিন্দক ভেলকারোহণে ভাসিতে ভাসিতে একটা প্রাকার-পরিবেষ্টিত চতুদ্বার নগরে উপস্থিত হলেন। এই নগর হচ্ছে উৎসাদ নামক নরক। এখানে বহুজীব নিরয়গামী হয়ে তাদের স্বীয় কর্মফল ভোগ করে থাকেন। কিন্তু মিত্রবিন্দকের দৃষ্টিতে ইহা অতি মনোহর স্থান বলে প্রতীয়মান হল। তিনি ভাবলেন, আমি এই নগরে প্রবেশ করে এখানকার রাজা হব। অতপর নগরে প্রবেশ করে তিনি দেখলেন, এক পাপী মস্তকে ক্ষুরচক্র বহন করে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতেছেন। কিন্তু মিত্রবিন্দক মনে করলেন ইহা ক্ষুরচক্র নহে, স্বর্গের প্রস্ফুটিত শতদল। তার সমীপবর্তী হয়ে মিত্রবিন্দক বললেন, আপনি ত অনেকক্ষণ এই পদ্মটি মাথায় ধারণ করে আছেন। আমায় একবার ধরতে দিন। লোকটি বললেন, ইহা পদ্ম নয়, ক্ষুরচক্র। কিন্তু মিত্রবিন্দক তা কর্ণপাত করল না। তখন নিরয়বাসী লোকটি ভাবলেন, এও মনে হয় আমার ন্যায় মাতাকে প্রহার করে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। তখন লোকটি মিত্রবিন্দকের মাথায় ক্ষুরচক্রটি রাখা মাত্রই তার মস্তক পেষণ করতে লাগল। মিত্রবিন্দক তখন বুঝতে পারলেন যে ইহা প্রকৃতই ক্ষুরচক্র। অবিদ্যার ফলশ্রুতিতে তাঁকে নরকযন্ত্রনা ভোগ করতে হচ্ছে। তাই আমাদেরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে প্রতিনিয়ত কুশল কর্মে রত থেকে পুণ্য সঞ্চয়ের সাহায্যে নরকের তালিকা থেকে সবার নামটি মুছে ফেলা উচিত। বাংলাদেশের ন্যায় অপ্রতিরুপ দেশে থেরবাদী বৌদ্ধ হয়ে জন্ম নেওয়াটাই আমাদের জন্য পরম পাওয়া এবং ইহাই নরকযন্ত্রনা থেকে পরিত্রানের এক সুবর্ণ সুযোগ।